দোয়া তাবিজ বা আমলের নিয়ম সমূহ (মুসলিম পদ্ধতি)

আমালিয়াতের বিবরণ

কুরআন শরীফ মুমিন বান্দাদের জন্য অপূর্ব নিয়ামত স্বরূপ। ইহা যেমন মানুষদিগকে তাহাদের রূহানী রোগ-ব্যধি বিদূরিত করিয়া খাঁটি মানুষরূপে গঠন করিয়া থাকে, তেমন মানবকুলের রোগ-ব্যধি, শোক-তাপ, দুঃখ-দুর্দশা, বালা-মুছিবত, অভাব-অনটন ইত্যাদি বিদূরিত করিয়া তাহাদেরকে শান্তিময় জীবন যাপনের সুযোগ দান করিয়া থাকে। পবীত্র কালামে পাকে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করিয়াছেন—

অর্থ: আর আমি কুরআন শরীফের এরূপ কতিপয় অংশ নাযিল করিয়াছি যাহা মুমিনদিগের জন্য শেফা ও রহমত স্বরূপ।

ধর্মানুরাগী বুযুর্গ আলেমগণরা কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত সমূহের আমল করিয়া অপূর্ব ফল লাভ করিয়াছেন এবং করিতেছেন। ইহা ব্যতিত তাহারা অন্যান্য মানুষদিগের উপকার সাধন করিতে সক্ষম হইয়াছেন এবং দোয়া, কালাম ও তাবিজের মাধ্যমে অশেষ উপকার করিতেছেন। অনেক সময় দেখা গিয়াছে যে, বহু লোকে কঠিন বিমারে আক্রান্ত হইয়া ডাক্তারী মতে অনেক টাকা পয়সা খরচ করিয়া আরগ্য না হইয়া হতাশাগ্রস্ত হইয়া শেষ পর্যন্ত একজন বুজুর্গ আলেমের একটু পানি ও তৈল পড়া বা তাবিজ ব্যবহার করিয়া তাহারা আরগ্য লাভ করিয়াছেন। এইরূপ উদাহরণ হাজার হাজার পাওয়া যায়। যেমন জ্বিন-পরীর আছর বা যাদুটোনা ও বাণের আছর ডাক্তার দ্বারা কখনো ফল পাওয়া যায় না ইহা শুধু আল্লাহর কালামের দ্বারা বুজুর্গ লোকের মাধ্যমে ঝাড়-ফুক ও তাবিজের দ্বারা আরোগ্য লাভ হইয়া থাকে। আল্লাহ তাআলার অসীম রহমতে যে কোন আমলের ফল অবশ্যম্ভাবী। চেষ্টা সাধনা কখনো বিফল হয় না, যদি উহার ফলাফল সম্পর্কে দিলের ভিতর পূর্ণ বিশ্বাস থাকে। পূর্ণ বিশ্বাস না থাকিলে আমলের মাধ্যমে কোন ফল লাভ হয় না। আমল কারীকে কতকগুলি শর্তাবলী পালিত করিতে হয়, উহা নিম্নে উল্লেখ করা হইলঃ

১। আমলকারী সর্বদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা বলিবে না, শয়তানী ধারণা হইতে অন্তরকে পাক রাখিতে হইবে, সর্বদা হালাল খানা খাইতে হইবে। আমল করিবার সময় উদ্দেশ্যের নিয়ত করিয়া অন্তরে উহার খেয়াল রাখিয়া মনোযোগী হইতে হইবে। নতুবা উহার দ্বারা কোন উপকার হইবে না।

২। আমলকারী যে উদ্দেশ্যে যতদিন আমল করিবে, তখন কোন জীব-জন্তুর গোস্ত খাইবে না। এবং মাছ, ডিমও ভক্ষণ করিবেনা, পিয়াজ ও রশুন না খাওয়া উত্তম। এই বস্তুগুলি হইতে আমলকারী বিরত থাকিলে তাহার আমলে উপকার আশা করা যায়।

৩। আমালিয়াতের জন্য সময় নির্দ্ধারণ করা একান্ত জরুরী। যেমন যে কোন আমল প্রথম দিন জালালী বা জামালী সময়ের ভিতরে আরম্ভ করিতে দৈনিক ঐ সময়ের ভিতরেই সেই আমল করিবে। সময়ের হেরফের করিলে ক্ষতির সম্ভাবণা থাকে।

৪। আমলের জন্য স্থান নির্দিষ্ট করিয়া লইতে হইবে। জরুরী কারণ ব্যতীত স্থান পরিবর্তন করা উচিৎ হইবে না। প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একই বিছানার উপর আজিফা পড়িতে হইবে, স্থান পরিবর্তন করিবে না।

৫। যখন যেই আমল শুরু করিবে উহা চন্দ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের পূর্বে অর্থাৎ চৌদ্দ তারিখের পূর্বে শুরু করিবে।

৬। যে সময় আমল করিতে মনস্থ করিবে, তখন সর্বাগ্রে তিনবার অথবা সাতবার ছার ফুঁক দিবে। তারপর শাহাদত অঙ্গুলী দ্বারা বসার স্থানের চতুর্দিকে রেখা টানিয়া বন্ধকী দিয়া লইবে। তারপর যথা নিয়মে আমল করিবে।

৭। যখন যেই এছেম বা দোয়া পাঠ করিবার এরাদা করিবে যদি উহার প্রথম অক্ষর এবং পাঠকারীর নামের প্রথম অক্ষর জালালী অথবা জামালী হয় তবে তাহার ফলাফল শিঘ্রই ফলিবে।

৮। যখন কোন আলেম আমলের যাকাত আদায় করিয়া থাকে, তখন তাহার জন্য কর্তব্য হইবে যে প্রতিদিন সাত বার অথবা ১২ বার কিংবা তাহার চেয়ে আরো বেশী পরিমাণে উহা পাঠ করা। খেয়াল রাখিতে হইবে উহা যেন কোন দিন বাদ না যায়। যাকাতের নিয়মাবলী সম্মুখে বর্ণনা করা হইবে।

৯। আমল করিবার জন্য বুজুর্গ আলেম বা পীর মাশায়েখের এজাজত একান্ত জরুরী। এজাজত ছাড়া আমল করিলে ক্ষতি হইবে। অতএব আমল কারীকে অবশ্যই এজাজত লইতে হইবে।

আমল বা তাবিজ লিখিবার দিন-ক্ষণ

প্রতি মাসকে দশ দিন করিয়া তিন ভাগে ভাগ করা হইয়াছে। প্রথম দশ দিন-রুজী রোজগার, ধনদৌলত বৃদ্ধি, উদ্দেশ্য সফল এবং বিজয় লাভের জন্য। দ্বিতীয় দশদিন প্রেম, ভালবাসা, মহত্ত্ব ও অবাধ্যকে বাধ্য করিবার জন্য। তৃতীয় দশদিন-শত্রুর শত্রুতার জন্য। সকল আমলকারীকে আমল করিবার সময় উপরোক্ত দিনক্ষণের প্রতি লক্ষ রাখিতে হইবে।

রোগমুক্তি, রুজী বৃদ্ধি এবং অপরকে বাধ্য করা বা বশীভূত করার জন্য সোমবারে আমল বা তাবিজ লিখিবে। ধন-দৌলত বৃদ্ধির বা উন্নতির জন্য বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ছাড় শনিবার, রবিবার ও শঙ্গলবার আমল করিবে। আর জবান বন্ধ করিবার জন্য রবিবার ও বুধবার আমল করিবে।

তাবিজের প্রকারভেদ

তাবিজ বিশারদগণ সমস্ত তাবিজকে চার ভাগে ভাগ করিয়াছেন যথা—

১। আতশী
২। আবী
৩। বাদী
৪। খাকী

প্রথম প্রকার আতশী তাবিজ ঐসকল তাবিজকে বলা হয় যাহা আগুণের মধ্যে ফেলিয়া দেওয়া হয় কিংবা চুলার মধ্যে বা পার্শ্বে গাড়িয়া রাখা হয়। এই সকল তাবিজ বিজয়, জবান বন্ধ কিংবা নিদ্রা বন্ধের জন্য হইয়া থাকে।

দ্বিতীয় প্রকার বাদী তাবিজ ঐ সকল তাবিজকে বলা হইয়া থাকে যাহা কোন বৃক্ষের ডালে বাঁধিয়া রাখা হয় কিংবা কোন উচু স্থানে টাঙ্গাইয়া রাখা হয় যাহাতে উহা বাতাসের দ্বারা নড়াচড়া করিতে পারে। এই প্রকারের তাবিজ প্রেম-ভালবাসা ও মহব্বতের জন্য হইয়া থাকে। তৃতীয় প্রকার আবী তাবিজ ঐ সকল তাবিজকে বলা হইয়া থাকে যাহা সাগর, নদী কিংবা যুয়ার মধ্যে ফেলিয়া দেওয়া হয়। এই প্রকারের তাবিজ বন্দীমুক্তি ; নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধান কিংবা অবাধ্যকে বাধ্য করিবার জন্য হইয়া থাকে।। চতুর্থ প্রকার খাকী তাবিজ ঐসকল তাবিজকে বলা হইয়া থাকে যাহা খাটের নীচে, রাস্তার চৌমাথায় কিংবা যেকোন রাস্তায় অথবা করব স্থানে ও পাহাড় পর্বতে গাড়িয়া রাখা হয়। এই প্রকারের তাবিজ অবাধ্যকে বাধ্য করা বিংবা উভয়ের মধ্যে জুদায়ী অথবা শত্রু ধংশ করার জন্য হইয়া থাকে।

আতশী, আবী, বাদী, ও খাকী তাবিজ লিখিবার শর্ত সমূহঃ

১। আতশী তাবিজ লিখিবার শর্ত হইতেছে-আলেমকে পূর্বদিকে মুখ করিয়া চুলা অথবা প্রজ্জলিত আগুনের নিকট বসিয়া লিখিতে হইবে।

২। বাদী তাবিজ লিখিবার শর্ত হইতেছে-আলেমকে পশ্চিমমুখী হইয়া উঁচু স্থানে যেখানে বাতাস চলাচল করে সেখানে বসিয়া তাবিজ লিখিবে।

৩। আবী তাবিজ লিখিবার শর্ত হইতেছে-আলেমকে উত্তরমুখী হইয়া নদীর কিনরায় বা পুকুরের পাড়ে অথবা যেকোন জলাশয়ের নিকট বসিয়া তাবিজ লিখিবে। যদি উপরোক্ত প্রকারের স্থান পাওয়া না যায় তাহা হইলে, একটি কলসীতে পানি ভর্তি করিয়া উহার পার্শ্বে বসিয়া তাবিজ লিখিবে।

৪। খাকী তাবিজ লিখিবার শর্ত হইতেছে-দক্ষিণ মুখী হইয়া খালী গৃহে সুগন্ধি জালাইয়া তাবিজ লিখিবে।

আমলের যাকাতের নিয়ম

সকল প্রকার আমলের নিয়ম হইতেছে এই যে, যে এছেম বা যে দোয়া ও আয়াতের আমল করিবার এরাদা করিবে তাহার আবজাদী সংখ্যা বাহির করিতে হইবে। এবং সেই হিসাবের সংখার পরিমান নির্দিষ্ট স্থানে একই সময়ে চল্লিশদিন পর্যন্ত সেই দোয়া বা এছেম কিংবা আয়াত পাঠ করিতে হইবে। আর তাবিজের যাকাতের নিয়ম এই যে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত নকশার যত সংখা হইবে তত সংখ্যা পরিমাণ তাবিজ লিখিয়া আটার ভিতরে আলাদা ভাবে ভরিয়া গুলি বানাইবে। এরপর সমস্ত গুলি নদীতে নিক্ষেপ করিবে। এইভাবে চল্লিশ দিন পুরা হইলে পর তাবিজের যাকাত আদায় হইবে। ইহার পরে সেই তাবিজ যে রোগের জন্য লিখিয়া দিবে উহার ফলাফল শিঘ্রই লাভ করিবে।

দোয়া করিবার নিয়ম-পদ্ধতি

হয়রত রাছূলুল্লাহ (ছঃ) এরশাদ করিয়াছেন — যখন দোয়া করিবে তখন সর্ব প্রথম আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করিবে, তাহার পরে আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করিবে। ইহার পরে স্বীয় গুনাহের কথা স্বীকার করিয়া কান্নাজরিত কন্ঠে কাকুতি মিনতি সহকারে আল্লাহর নিকট মাফ চাহিবে এবং দোয়া কবুলের বাসনা অন্তরে রাখিবে। আল্লাহর রহমতে দোয়া কবুল হইবে। কিন্তু কোন পাপ কার্যের জন্য দোয়া করিলে কিংবা আত্মীয়তা ছিন্ন করিলে দোয়া কবুল হইবে না। দোয়া কবুল হইবার তিনটি স্তর বা নিদর্শন রহিয়াছে। প্রথমত সেই বিষয়ের জন্য দোয়া করা হয় আল্লাহ তাআলা তাহাই বাস্তবায়িত করেন। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর নিকট যেই বিষয়ের জন্য দোয়া করা হইয়াছে উহা বাস্তবায়িত না করিয়া অন্য কোন বিপদ যাহা তাহার উপর প্রবর্তিত হইবার ছিল তিনি তাহা দূর করিয়া দেন। তৃতীয়তঃ আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে সেই দোয়ার প্রতিফল না দিয়া আখেরাতের জন্য উহার ছওয়ার জমা রাখিয়া দেন। হযরত রাছুলে করীম (ছঃ) এরশাদ করিয়াছেন— যেই সকল দোয়ার প্রতিফল পৃথিবীতে দেওয়া হয়না উহা কেয়ামতের দিন দেওয়া হইবে। সেই লোক কেয়ামতের দিন মহা বিপদের সময় উহার প্রতিফল দেখিয়া  বলিবে যে, হে আল্লাহ তাআলা ! আমি আগেই জানিয়া ছিলাম, আমার দোয়ার বদলা এত অধিক। তখন সে ব্যক্তি আফছুছ করিয়া বলিবে যে, যদি পৃথিবীতে আমার কোন দোয়া কবুল না হইত তবে এখন কতইনা ভাল হইল। অতএব দোয়ার প্রতিফল দুনিয়াতেই যে ফলিবে এমন ধারণা করা ঠিক নয়। আবার অনেক সময় দোয়ার প্রতিফল অনেক দেরিতেও ফলিয়া থাকে। যেমন হযরত নূহ (আঃ) এর কওমের জন্য যে বদদোয়া করিয়া ছিলেন উহা চল্লিশ বৎসর পরে তুফান হিসাবে ফলিয়াছিল। মূল কথা হইতেছে এই যে, আল্লাহর দরবারে দোয়া করিয়া উহার প্রতিফলের জন্য তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়। আল্লাহ তায়ালা কোন কোন দোয়ার প্রতিফল সঙ্গে সঙ্গে কবুল করিয়া থাকেন। আবার কখনো দেবিরতে প্রতিফল দিয়া থাকেন বা কখনো উহা কেয়ামতের জন্য জমা করিয়া রাখেন। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে নিয়াশ হওয়া ঠিক নয়। তিনি কোরআন শরীফে ঘোষণা করিয়াছেন- “তোমরা আল্লাহ তাআলার রহমত হইতে কখনো নিরাশ হইওনা।” দোয়া কবুল হওয়ার প্রধান শর্ত হইতেছে, দোয়াকারীকে অবশ্যই হালাল রুজী ভক্ষণ করিতে হইবে। যাহার হারাম বস্তু পানাহার করিবে ও হারাম পোষাক পরিধান করিবে তাহাদের দোয়া কখনো কবুল হইবে না। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানকে উহা হইতে বাঁচিয়া থাকিতে হইবে। বিশেষভাবে যাহারা আমল করিবে, তাবিজ ইত্যাদি লিখিবে, তাহারা অবশ্যই হালাল বস্তু পানাহার করিবে ও মিথ্যা হইতে বাঁচিয়া থাকিবে।

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url