উচ্চ রক্তচাপ আয়ত্তে না রাখলে মৃত্যুও হতে পারে
উচ্চ রক্তচাপ আয়ত্তে না রাখলে মৃত্যুও হতে পারে। আসুন জেনে রাখি; উচ্চ রক্তচাপ সমন্ধে কিছু প্রশ্নের উত্তর ও চিকিৎসা পদ্ধতি।
অধ্যাপক (ডাঃ) অবনী রায়চৌধুরী
❏ প্রশ্ন: কী করে বুঝব রক্তচাপ বেড়েছে, ডাক্তার দেখাতে হবে?
☛ উত্তর: অনেক সময় বুঝতে পারা যায় না। অন্য কোনও কারণে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে জানতে পারা যায় রক্তচাপ বেড়েছে। এছাড়া কিছু উপসর্গ আছে যা অনেক সময় রক্তচাপ বাড়ার জন্যও হতে পারে। যেমন,
(১) মাথাব্যথা, বিশেষ করে মাথার পেছন দিকে ব্যথা, অনেক সময় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মাথা ব্যথা আরম্ভ হয়। দু ' চার ঘণ্টা পরে আবার কমে যায়।
(২) মাথা ঘােরা
(৩) বুক ধড়ফড় করা
(৪) মনঃসংযােগের অভাব
(৫) ক্লান্তি
(৬) অল্প কাজে হাঁপ ধরা
(৭) মাংসপেশির দুর্বলতা
(৮) পা ফোলা
(৯) বুক ব্যথা
(১০) নাক দিয়ে রক্ত পড়া
❏ প্রশ্ন: যে কোনও বয়সেই এই জাতীয় সমস্যা দেখা দিলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি?
☛ উত্তর: অবশ্যই। তবে সবসময় রক্তচাপ বাড়ার জন্যই এরকম হয় তা নয়। অন্য কারণেও হতে পারে।
❏ প্রশ্ন: কত বছর বয়স থেকে রক্ত চাপের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত?
☛ উত্তর: কোনও অসুখ বিসুখ না থাকলে মােটামুটি ৩০-৩৫ বছর বয়সের পর থেকে কিছু সাবধানতা মেনে চলা ভাল।
❏ প্রশ্ন: অসুখ বিসুখ বলতে?
☛ উত্তর: কিডনি বা এন্ডােক্রিন গ্ল্যান্ডের কিছু অসুখে রক্তচাপ বাড়ে। আরও কিছু অসুখ আছে
যেমন কোয়ার্কটেকঅফ এওরটা, পরফাইরিয়া, হাইপারক্যালসিমিয়া ইত্যাদি রােগে রক্তচাপ বাড়ে।
❏ প্রশ্ন: কোনও অসুখ ঘসও রক্তাপ বাড়তে পারে?
☛ উত্তর: শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে রক্তচাপ বাড়ার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ধরনের রক্তচাপ পরিবারের একাধিক সদস্যের মধ্যে থাকে। অর্থাৎ অনেক সময়ই বংশানুক্রমে বাহিত।
❏ প্রশ্ন: গর্ভাবস্থাতেও তাে অনেক সময় রক্তচাপ বাড়ে?
☛ উত্তর: হ্যা। এবং অধিকাংশ সময় সন্তান জন্মের পর রক্তচাপ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।
❏ প্রশ্ন: ব্যথা কমার ওষুধ খাওয়াকালীন রক্তচাপ বাড়তে পারে?
☛ উত্তর: শুধু ব্যথা কমার ওষুধ নয়, স্টেরয়েড, অ্যাড্রিনালিন, জন্মনিরােধক ট্যাবলেট ইত্যাদি খেলেও সেই সময়ের জন্য রক্তচাপ বাড়ে।ওষুধ বন্ধ করার পর আবার ঠিক হয়ে যায়।
❏ প্রশ্ন: রক্তচাপ কত হলে ওষুধ খাওয়া শুরু করতে হবে?
☛ উত্তর: ২০-৪০ বছর বয়সের কোনও মানুষের রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর ওপরে হলে সে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত বলা হয়। এর আবার তিনটে ভাগ আছেঅল্প, মাঝারি আর মারাত্মক। ১৪০/৯০ থেকে ১৫৯/১০৪ এর মধ্যে হলে উচ্চ রক্তচাপ অল্পমাত্রায় আছে। ১৬০/১০৫—১৯৯/১১৪ মাঝারি এবং ২০০/১১৫ হলে মারাত্মক। মাঝারি এবং মারাত্মক উচ্চ রক্তচাপের রােগীদের ওষুধ খেতে হবে। মৃদু উচ্চ রক্তচাপের রােগীদের ক্ষেত্রে দ্বিমত আছে। অনেক সময় এদের ওষুধ না দিয়ে জীবনযাত্রার নিয়ম কানুন মেনে চলতে বলা হয়।
❏ প্রশ্ন: জীবন যাত্রার নিয়ম কানুন বলতে?
☛ উত্তর: জীবন যাত্রার ধরনে সামান্য হেরফের ঘটিয়ে রক্তচাপ আয়ত্তে রাখা। যেমন,
(১) ওজন ঠিক রাখা। উচ্চতার সঙ্গে ওজনের একটা সম্পর্ক আছে। যেমন, ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার যুবকের ওজন হওয়া উচিত ৬০-৬৫ কেজির মধ্যে। যে শুয়ে বসে দিন কাটায় তার ৬০ এর মধ্যে হওয়া ভাল। খাটিয়ে মানুষের ক্ষেত্রে ৬৫।
(২) দিনে অন্তত ২ কিলােমিটার একটানা হাঁটতে হবে। ৪৫ মিনিটের মধ্যে। একটানা’কথাটা খেয়াল রাখা দরকার। অনেকেই এসে বলেন, ডাক্তারবাবু, দিনে তাে কত হাঁটি ! যতই হাঁটুন, একটানা একটা নির্দিষ্ট গতিতে না হাঁটলে ফল পাবেন না।
(৩) খাওয়া দাওয়া বুঝে শুনে করতে হবে।
(ক) কাঁচা নুন একদম খাওয়া যাবে না। রান্নাতেও নুন কম দিতে হবে।
(খ) যে খাবারে ওজন এবং কোলেস্টেরল বাড়ে, যেমন, মিষ্টি আলু, ঘি, মাখন, অলডা, ডিমের কুসুম, পাঠার মাংস, ভাজাভুজি, তৈলাক্ত খাবার ইত্যাদি না খাওয়াই ভাল।
(৪) মানসিক চাপ, টানাপােড়েন এড়িয়ে চলতে হবে। দরকার হলে সাইকলােজিকাল কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিতে হবে। চাপ বেশি বেড়ে গেলে রাত্রে খাওয়ার ১৫ মিনিট আগে একটা করে অ্যালপ্রাজোলাম ট্যাবলেট খাওয়া যেতে পারে।
(৫) সিগারেট, জর্দা, দোক্তা, অথাৎ যে কোনও তামাক জাতীয় জিনিস পুরােপুরি ছেড়ে দিতে হবে।
(৬) কিছু ওষুধ যেমন গর্ভনিরােধক বড়ি, কর্টিকোস্টেরয়েড, ব্যথা কমার ওষুধ
(এন এস এ আই ডি) জাতীয় ওষুধ রক্তচাপ বাড়াতে পারে। কাজেই এদের ত্যাগ করা ভাল।
❏ প্রশ্ন: তেলের কথা কিছু বললেন না? রক্তচাপ বেশি থাকলে সূর্যমুখী তেল শুনেছিভাল।
☛ উত্তর: সূর্যমুখী তেল খাওয়া যায়। সর্ষের তেল, বাদাম তেল, সাফোলা খাওয়া যায় যে কোনও টাই। কোনও বিশেষ ব্যাপার নেই। তবে একটা বয়সের পর তৈলাক্ত জিনিস যত কম খাওয়া যায় ততই ভাল।
❏ প্রশ্ন: আর ডাবের জল?
☛ উত্তর: ইচ্ছে হলে খাবে।
❏ প্রশ্ন: এমন কিছু খাবার নেই যা খেলে রক্তচাপ কমে?
☛ উত্তর: আগে ভাল ওষুধপত্র ছিল না। লােকে দুধভাত খেত। ক্যালসিয়াম বেশি আছে যে সমস্ত খাবারে যেমন, দুধ, ছানা, ছােট মাছ, পেঁয়াজ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। তবে এগুলি কিন্তু ওষুধের কাজ করবে না। দরকার হলে ওষুধ খেতে হবে।
❏ প্রশ্ন: কিন্তু রক্তচাপ ঠিম হয়ে গেলেও যে আপনারা ওষুধ বন্ধ করতে দেন না?
☛ উত্তর: ওষুধ বন্ধ করতে দিই না তার কারণউচ্চ রক্তচাপ সারেনা। ওষুধ খেলে আয়ত্তে থাকে। তাই অনেকে মনে করেন সেরে গেছে। হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ করলে। রক্তচাপ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
❏ প্রশ্ন: কী রকম দুর্ঘটনা?
☛ উত্তর: উচ্চ রক্তচাপের ব্যাপারে একটা কথা চালু আছে। রক্তচাপ পুশে রাখলে- Pump may fail, Filter may stop, Tube may burst. অর্থাৎ হার্টফেল হতে পারে, কিডনি তার কার্যকারিতা হারাতে পারে বা স্ট্রোক অর্থাৎ মাথার কোনও শিরা ছিড়ে যেতে পারে। মারাত্মক হলে ফল মৃত্যু।
❏ প্রশ্ন: এইসব ওষুধের তাে নানারকম কুফলও আছে।
☛ উত্তর: কুফল সুফলের বিচার করেই ওষুধ দেওয়া হয়। ওষুধও নানারকম। একেকজনের ক্ষেত্রে একেকটা কাজে আসে। তা সত্ত্বেও ওষুধ খাওয়া কালীন কিছু অসুবিধে দেখা দিতে পারে। যেমন,
(১) রক্তচাপ হঠাৎ করে কমে যাওয়া
(২) মাথা ব্যথা, ঘােরা
(৩) কাশি
(৪) পা ফোলা।
(৫) স্বাভাবিক বিবাহিত জীবনযাপনে অনীহা ইত্যাদি। এরকম হলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন।
❏ প্রশ্ন: রক্তচাপ খুব বেশি ওঠানামা করা খারাপ?
☛ উত্তর: নিশ্চয়ই। খুব বেশি টানাপােড়েনে ভােগেন যাঁরা তাঁদের ক্ষেত্রে এরকম হতে পারে। ওষুধপত্র ঠিকঠাক না খেলেও এরকম হয়।
❏ প্রশ্ন: সব রকম চিকিৎসা চলছে অথচ রক্তচাপ কমছে না এরকমও হতে পারে?
☛ উত্তর: সম্ভাকা কম। তবে কিছু ক্ষেত্রে হয়। বিশেষত, রােগী যদি
(১) ঠিকমতাে ওষুধ না খান
(২) বেশি নুন খান
(৩) ওজন বাড়তে থাকে
(৪) অন্য কোনও ওষুধ, যেমন জন্ম নিরােধক বড়ি, স্টেরয়েড, এফিড্রিন ইত্যাদির কোনও একটা খান
(৫) অন্য কোনও রােগের কারণে উচ্চ রক্ত চাপ থাকে
❏ প্রশ্ন: একই মানুষ, বিভিন্ন জায়গায় রক্তচাপ মাপিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন হয়। এটা কি যন্ত্রের ক্রটি?
☛ উত্তর: নানা কারণে এরকম হতে পারে। প্রথমত, একই মানুষের রক্তচাপ দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হতে পারে। অফিসের মিটিংয়ের সময় যা রক্তচাপ, আরাম করে বই পড়া বা বিশ্রাম করার সময় তা থাকে না। চাপা মানসিক অশান্তি চললেও রক্তচাপ বেড়ে যায়। সেজন্য রক্তচাপ মাপবার আগে মিনিট ১৫ শুয়ে থাকা এবং চা বা সিগারেট না খাওয়া নিয়ম। সব সময় এভাবেই রক্তচাপ মাপালে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কেউ যদিবসে রক্তচাপ মাপান, সবসময় সেভাবেই মাপালে চাপ মােটামুটি এক থাকবে। যন্ত্র সবসময় একই ধরনের ব্যবহার করা ভাল। অনেক সময় দেখা যায় নার্স রক্তচাপ মাপলে যা হচ্ছে, ডাক্তার মাপলে তা বেড়ে যাচ্ছে। একই মানুষ, একই মেশিন, একই অবস্থায়। ডাক্তার মাপলে অনেক সময় রােগীর মানসিক চাপ বেড়ে যায়। তাই এরকম হয়। সবথেকে ভাল রােগী যদি নিজে একটি যন্ত্র কিনে নেন। নিজের মেশিনে পরিচিত মানুষ রক্তচাপ মাপলে এদিক ওদিক হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।