টাইফয়েড রোগ নিয়ে যত প্রশ্ন ও তার উত্তর
টাইফয়েড প্যারাটাইফয়েড এড়াতে জল ফুটিয়ে খান এবং আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর।
অধ্যাপক (ডাঃ) পঞ্চানন মৌলিক
❏ প্রশ্ন: গলব্লাডারের সমস্যা থাকলে নাকি টাইফয়েড হওয়ার প্রবণতা থাকে?
☛ উত্তর: ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। টাইফয়েড হওয়ার পর সম্পূর্ণ চিকিৎসা না হলে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়া গল ব্লাডার অথবা কোলনে বাসা বেঁধে এদের মাধ্যমে রােগ ছড়াতে পারে।
❏ প্রশ্ন: কীভাবে?
☛ উত্তর: মলমূত্রের মাধ্যমে।
❏ প্রশ্ন: মলমূত্রের মাধ্যমে? তবে যে শুনেছি দূষিত জল এবং খাবার থেকে টাইফয়েড হয়?
☛ উত্তর: ঠিক শুনেছে। জীবাণু বহনকারী মলমূত্রের মাধ্যমে দূষিত জলই টাইফয়েড ছড়ায়। নানাভাবে ব্যাপারটা ঘটে। প্রথমত, বর্ষাকালে বা বন্যার সময় চতুর্দিক জলে ভেসে যায়। সব একাকার হয়ে যাওয়ার দরুণ জল দূষিত হয়ে পড়ে। এই জল পরিশােধন করে রান্না, খাওয়া বা বাসন পত্ৰ ধােওয়ার কাজে ব্যবহার করলে জীবাণু সরাসরি শরীরে এসে ঢােকে। শহরাঞ্চলে মাটির নীচে খাওয়ার জলের পাইপ আর আবর্জনা ধুয়ে আসা নােংরা জলের পাইপ পাশাপাশি বয়ে চলে। সঠিক নজরদারির অভাবে পাইপ ফুটো হয় নােংরা জল এবং খাবার জল মিশে যেতে পারে। ফলে পানীয় জলে মিশে যায় জীবাণু। তৃতীয় কারণ রাস্তায় বাসনকোসন দূষিত গঙ্গা জলের ফোয়ারায় বােয়া। রাস্তার হোেটল রেস্টুরেন্টে এই সব বাসনে করেই খাবার দেওয়ার চল। অফিস কাছারি বা বহুতল বাড়ির দীর্ঘকাল অপরিশােধিত জলের ট্যাঙ্কও অনেক সময় টাইফয়েড জীবাণুর বাড়বৃদ্ধির জায়গা হয়ে দাঁড়ায়।
❏ প্রশ্ন: কীভাবে তাহলে এই পরিস্থিতি ঠেকানাে যাবে?
☛ উত্তর: জল খুব ভালাে ভাবে ফুটিয়ে খেতে হবে। নােংবা জলে স্নান করা, বাসন পত্র ঘােয়া চলবেনা। অতএব রাস্তার খাবারও খাওয়া যাবে না। যাদের সামর্থ্য আছে তাঁরা বাইরের মিনারেল ওয়াটার খেতে পারেন। অথবা বাড়ি থেকে ফোটানাে জল নিয়ে বেরােতে পারেন।
❏ প্রশ্ন: রাস্তার গরম খাবার খেলে নাকি সমস্যা হয় না?
☛ উত্তর: গরম ধােয়া ওঠা খাবারে সমস্যা কম হয় কিন্তু নােংরা জলে ধােয়া বাসনপত্রের মাধ্যমেও জীবাণু আসতে পারে। রাস্তায় খেতে হলে বাসনপত্রও গরম জলে ধুয়ে নিতে হবে। যে সমস্ত খাবার হাত দিয়ে পরিবেশন করা হয় যেমন, ফুচকা, আলুকাবলি ইত্যাদি একদম খাওয়া চলবে না।
❏ প্রশ্ন: কিন্তু এই যে বছর বছর বন্যা হয়, এর মধ্যে কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন ধারণ করা সম্ভব?
☛ উত্তর: খুবই অসুবিধে। তবে প্রাণ বাঁচানাের তাগিদে জল ফুটিয়ে খেতে হবে।
❏ প্রশ্ন: শুধু ফুটিয়ে নিলেই কি জল পানের যােগ্য হবে?
☛ উত্তর: পুকুর বা খােলা কুয়াে থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করা হলে তাতে ফিটকিরি দিয়ে সারারাত রেখে দিতে হবে। তারপর ছেঁকে নিয়ে ফোটানাের পর মেশাতে হবে হ্যালােজেন ট্যাবলেট অথবা এক চিমটে ব্লিচিং পাউডার। তার আধঘণ্টা বাদে সেই জল খাওয়ার উপযুক্ত হবে। যাঁরা বাড়িতে ফিল্টার ব্যবহার করেন তাঁদের উচিত জল ফুটিয়ে তবে ফিল্টার করা। অথবা ফিল্টার করার পর হ্যালােজেন মেশাননা। এবং নিয়মিত ফিল্টার ক্যান্ডেল পবিষ্কার করা। কারণ ফিল্টার কেবল জলে অদ্রবণীয় পদার্থ এবং কিছু ব্যাকটিরিয়াকে আলাদা করতে পারে। এবং অপরিকৃত ক্যান্ডেল বেশি দিন ব্যবহার করলে সেখান থেকে নানা ধরনের জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।
❏ প্রশ্ন: টাইফয়েড থেকে পেপটিক আলসার হতে পারে?
☛ উত্তর: সঠিক চিকিৎসা না হলে ২-৩ সপ্তাহ পরে অন্ত্রে ঘা হতে পারে। রক্তবমি, কালাে পায়খানাও হতে পারে। তবে আজকাল সাধারণত রােগ অতদূর পৌঁছয় না।
❏ প্রশ্ন: কিন্তু টাইফয়েড নাকি সহজে ধরা পড়ে না?
☛ উত্তর: প্রথম সপ্তাহে ব্লাড কালচার, দ্বিতীয় সপ্তাহে ভিডাল টেস্ট এবং তৃতীয় সপ্তাহে পায়খানা পরীক্ষা করে রােগ ধরা পড়ার কথা। কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের উপসর্গ চেনার ক্ষমতা সে ক্ষেত্রে কাজে আসে। তবে কিছু আধুনিক পদ্ধতি যেমন ব্যাকটেক পদ্ধতিতে ব্লাড় কালচার করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথম ৩ দিনের মধ্যে রােগ ধরে ফেলা সম্ভব।
❏ প্রশ্ন: কী উপসর্গ দেখলে বােঝা যাবে রােগটা টাইফয়েড?
☛ উত্তর: উপসর্গ শুরু হয় অল্প জ্বর এবং কপাল ব্যথা দিয়ে। এরপর ৭-১০ দিনের মাথায় জ্বর বাড়তে বাড়তে ১০৪-১০৫ ° র মতাে হয়। সময়ের সঙ্গে জ্বরের বৃদ্ধির যদি গ্রাফ টানা যায় সেটা অনেকটা সিঁড়ির মতাে দেখতে হয়। এর সঙ্গে থাকে কোষ্ঠবদ্ধতা, খিধে না হওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি। ৫ দিনের মাথায় শরীরে ব্যাশ বেরােতে পারে। প্রথমে পেটে। মুখেও বেরােতে পারে। সাধারণভাবে জ্বরের জন্য হৃৎস্পন্দন যতখানি বাড়ার কথা তার থেকে কম বাড়ে। যেমন, ১০২° জ্বরের জন্য হৃৎস্পন্দন হওয়া উচিত ১১০° এর কাছাকাছি। এক্ষেত্রে হয় ৯০ এর আশপাশে। ৬-৭ দিনের মাথায় পিলে বড় হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক নিয়ম মানতে শুরু করে। জ্বর ১০১-১০৪° র মতাে থাকে। জিভে পুরু আস্তরণ, গায়ে ব্যাস এবং পিলের সঙ্গে লিভারও বড় হয়ে যায়। কোষ্ঠবদ্ধতা চলে গিয়ে এবার শুরু হয় ডায়েরিয়া। সঠিক চিকিৎসা না হলে তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রােগীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ডিহাইডেশন, জ্বর, রক্তচাপ কমে যাওয়া, ভুল বকা ইত্যাদি শুরু হয়। রােগী আচ্ছ হয়ে পড়তে পারে। ভুল বকতে শুরু করবে। মিশে যাবে বিছানার সঙ্গে। এ সময় পেটে ঘা হয়ে সেখান থেকে রক্তপাত শুরু হয়ে যেতে পারে।
❏ প্রশ্ন: উপসর্গের উপর ভিত্তি করেই কি চিকিৎসা শুরু হয়?
☛ উত্তর: টাইফয়েডের চিকিৎসায় ধৈর্যের প্রয়ােজন। প্রথম ৬-৭ দিন জ্বর এবং অন্যান্য উপসর্গ কমার জন্য ওষুধপত্র দিয়ে রাখলে কোনও ক্ষতি হয় না। এর সঙ্গে ভিটামিন। যদি মনে হয় টাইফয়েড হয়েছে ব্লাড কালচার করতে বলা হয়। তার রিপোের্ট আসতে ৩ থেকে ৭ দিন লাগে। অনেকেই ধৈর্য ধরতে পারেন না। অ্যান্টিবায়ােটিক দিয়ে দেন। কিন্তু এরকম করা ঠিক নয়। উপসর্গের সঙ্গে রক্ত পরীক্ষার (ব্লাড কালচার নয়) রিপাের্ট মিলিয়ে মনে সন্দেহ হলেও ভিজল টেস্ট এবং ব্লাড কালচারের রিপাের্টের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। জ্বর শুরু হওয়ার ৭ দিনের মাথায় ভিডাল টেস্ট করা হয়। ১০ দিনের মাথায় করা হয় স্টুল এবং ইউরিন কালচার। সাধারণ ভাবে ৭—৮ দিনের মাথায় কিছু হদিশ পাওয়া যায়। না পাওয়া গেলে এই সময় উপসর্গের ভিত্তিতে টাইফয়েডের চিকিৎসা শুরু করা যায়।
❏ প্রশ্ন: টাইফয়েড জটিল অবস্থায় পৌঁছলে কি তাকে প্যারাটাইফয়েড বলে?
☛ উত্তর: না, কোন ধরনের জীবাণু সংক্রমণ হয়েছে তার উপর নির্ভর করে রােগটা টাইফয়েড প্যারাটাইফয়েড। প্যারাটাইফয়েডের জটিলতা বরং একটু কম।
❏ প্রশ্ন: দুটি রােগের উপসর্গই কি এক?
☛ উত্তর: প্রায় এক।
❏ প্রশ্ন: আর চিকিৎসা?
☛ উত্তর: চিকিৎসাও এক।
❏ প্রশ্ন: আজকাল শুনছি পুরনাে টাইফয়েডের ওষুধে অনেক সময় রােগ ঠিক হয় না?
☛ উত্তর: মাল্টি ড্রাগ রেজিসট্যান্ট টাইফয়েড হলে অনেক সময় প্রচলিত ওষুধে কাজ হবে।
❏ প্রশ্ন: সেটা বােঝা যাবে কীভাবে?
☛ উত্তর: টাইফয়েডের চিকিৎসা সাধারণত হয় ক্লোরামফেনিকল বা সিপ্রােফ্লক্সাসিন দিয়ে। এতে কাজ না হলে দুটি ভাবনা আসে-- ( ১ ) রােগটা আদৌ টাইফয়েড কিনা, ( ২ ) নাকি মাল্টি ড্রাগ রেজিসট্যান্ট টাইফয়েড দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ব্লাড স্টুল এবং ইউরিন কালচারের রিপাের্ট হাতে এসে যাবে। কাজেই কোন অ্যান্টিবায়ােটিকে কাজ হবে সেটা বুঝতে পারা যায়।
❏ প্রশ্ন: তাহলে তাে ভিডাল টেস্ট এবং কালচাব রিপাের্ট পাওয়ার পরই চিকিৎসা শুরু করা ভাল?
☛ উত্তর: সে তাে সবসময়ই ভাল। তবে নানা জিনিস কাজ কবে এর ভেতরে। ( ১ ) হয়তাে রােগী এই রােগ শুরু হওয়ার ৫-৭ দিন বাদে, ( ২ ) ভিডল টেস্ট এবং কালচার করে তেমন কিছু পাওয়া গেল না, ( ৩ ) রােগী এবং বাড়ির লােক খুব অধৈর্য, ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করে দিতে হয়।
❏ প্রশ্ন: টাইফয়েডে খাওয়া দাওয়ার কিছু বিধি নিষেধ আছে?
☛ উত্তর: জ্বর শুরু হওয়ার পর থেকেই হিসেব করে খাওয়া দাওয়া করা দরকার। অবশ্য বমিভাব, বমি এবং মাথা ব্যথার দরুন রােগী তেমন কিছু খাওয়ার অবস্থায় থাকে না। বমি বন্ধ হওয়ার ওষুধ এবং ভিটামিনের সঙ্গে গ্লুকোজ এবং ইলেকট্রোলাইট মেশাননা জল, স্যুপ, ফলের রস, হরলিক্স, ঘােল, মুড়ি, বিস্কুট, গলাভাত, মাছ, পেঁপে বা আল সেদ্ধ ইত্যাদি খাওয়ানাে উচিত। ডায়েরিয়া শুরু হলে খাওয়ার ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া দরকার। অবস্থা খারাপ হলে স্যালাইন চালানাে হয়। মুখে গ্লুকোজের জল বা হরলিক্স ছাড়া আর কিছুই দেওয়া যায় না।
❏ প্রশ্ন: আর সেরে যাওয়ার পর?
☛ উত্তর: রােগ সারার পর সুস্থ হতে মােটামুটি ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। এসময় হালকা সহজপাচ্য খাবার অল্প অল্প করে খাওয়ানাে দরকার। একেবারে সেদ্ধ খাবার হলেও চলবে। তবে তেলমশলা কম দেওয়া বাঞ্ছনীয়। জল খেতে হবে বেশি করে। প্রয়ােজন বুঝলে গ্লুকোজ, ফলের রস ইত্যাদিও দেওয়া যাবে। তবে শরীব বুঝে। অনেকের ফলের রসে অম্বল হয়। গ্লুকোজ বেশি খেলে কারও আবাব পেট ফাঁপে। মােট কথা শরীরে সহা হবে এমন পুষ্টিকর অথচ হাল্কা খাবার খাওয়াতে হবে।