কষা কোষ্ঠবদ্ধতা পেটের সমস্যায় চিকিৎসা ও পরামর্শ

কড়া টয়লেট ট্রেনিং থেকে কোষ্ঠবদ্ধতা দেখা দিতে পারে 
—ডাঃ অরবিন্দ পাল।  

পেট খারাপ হলে কী করবেন? যা করতে হবে তা হলো— মারাত্মক কিছু না হলে প্রথম দু দিন বারে বারে নুন চিনির জল খাওয়া ছাড়া আর কিছু করবেননা।কারণ অধিকাংশ সময়ই ডায়েরিয়া হয় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের দরুন। ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে কিছু দূষিত পদার্থ। তা যুক্ত হয় অন্ত্রের অভ্যন্তরীণ কোষের সঙ্গে। এই বিবকে শরীর থেকে বার করার জন্য অস্ত্রের কোষ থেকে প্রচুর পরিমাণে জল বেরােতে শুরু করে। এর সঙ্গে মিশে থাকে শরীরের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় কিছুলবণ। কোলনের কাজ মলের জলীয় অংশ শোষণ করা। পরিমাণ বেশি হলে সে আর এ কাজ পুরােপুরি করে উঠতে পারে না। তখনই পেট খারাপ হয়। ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই বিষ শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। পেটখারাপও সেরে যায়। কিন্তু মাঝপথে পায়খানা বন্ধ করার ওষুধ খেলে বিষ শরীরে থেকে গিয়ে কষ্টকে প্রলম্বিত করতে পারে। 

❍ প্রশ্ন: তার মানে পেট খারাপ হলে দেড় দু দিন ঘরে বসে থাকব? 

☛ উত্তর: কয়েকটি সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়াই এই সময় ভাল। 

❍ প্রশ্ন: সাবধানতা বলতে? 

☛ উত্তর: প্রথম সাবধানতা-শরীরে জল এবং লবণের মাত্রা যাতে বিপদসীমার নীচে না নামছে পারে সে দিকে খেয়াল রাখা।না হলে কিডনি সহ শরীরের অন্যান্য অংশ আক্রান্ত হয়ে জীবন সংশয় হতে পারে। অনেক সময় পেট খারাপের সঙ্গে বমি ভাব থাকে বা বমিও হয়। কিন্তু মােটামুটি ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে বমিভাব সাধারণত কমে যায়। এই অবস্থায় ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি চালু করা দরকার। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির ও আর এস পাউডার কিনতে পাওয়া যায়। ফোটানাে ঠাণ্ডা জলে প্যাকেটের গায়ে লেখা পরিমাপ অনুযায়ী মিশিয়ে বারে বারে খেতে হবে। ওষুধের বদলে দিনে বার দুয়েক দু'চামচ করে ইসবগুল জলে গুলে খেয়ে নিলে উপকার পাওয়া যাবে। খিদে পেলে হালকা ঝােল ভাত। আর পরিপূর্ণ বিশ্রাম। দু’দিনে সুস্থ হয়ে উঠবেন। 

❍ প্রশ্ন: পেট খারাপে তার মানে ওষুধপত্রের কোনও ভূমিকা নেই? 

☛ উত্তর: সাধারণ অবস্থায় নেই। কিন্তু যদি সাবধানতা নেওয়া সত্বেও বমি পায়খানা বন্ধ না হয় এবং প্রসাব কমে আসতে শুরু করে ওপরের সঙ্গে যােগাযোগ করা সরকার। এর সালাইন দেওয়ার দরকার হতে পারে। এবং অ্যান্টিবায়ােটিক। 

❍ প্রশ্ন: পায়খানা বন্ধ করার ওষুধ খেলে নাকি কোষ্ঠবদ্ধতা হয়? 

☛ উত্তর: হতে পারে দু'চার দিনের জন্য। 

❍ প্রশ্ন: কোষ্ঠবদ্ধতাও তাে এক সমস্যা। ফীভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে একে ঠিক রাখা যায়? 

☛ উত্তর: কোষ্ঠকাঠিন্য বা কোষ্ঠবদ্ধতার মূলে রয়েছে খাবারে রাফেজের পরিমাণ কম থাকা। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পরিমাণ মতাে শাক সবজি, ফল, দুবিসুদ্ধ আটার রুটি, ডাল ইত্যাদি রাখা উচিত। মাছ, মাংস, ডিমের পরিমাণ কম থাকা দরকার। দিনে ৮ থেকে ১০ গ্লাস জল খেতে হবে। ভাজাভুজি, তেল মশলাদার খাবার কম খাওয়াই ভাল। প্রয়ােজন হলে দিনে দু'বার দু'চামচ করে ইসবগুলের ভুষি জলে গুলে খেতে হতে পারে। 

❍ প্রশ্ন: অনেক সময় এ সমস্ত নিয়ম মেনে চললে তাে দেখা যায় পেট পরিষ্কার হয় না। তখন কি কিছু ওষুধপত্র খাওয়া যেতে পারে। 

☛ উত্তর: পেট পরিষ্কার হওয়ার ব্যাপারে খাবারে রাফেজের পরিমাণের যেমন ভূমিকা আছে ভূমিকা আছে মনেরও। দেখবেন কোনও নতুন জায়গায় গেলে কারও কারও প্রথম এক দুদিন বেশ অসুবিধে হয়। পরিবেশের বর্জন মানাতে মানাতে দু-একদিন কেটে যায়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে বাওয়েল কনসাসনেস। একদিন কোনও কারণে পেট পরিষ্কার না হলে সারাদিন তা নিয়ে অস্বস্তি বােধ করা, পরের দিন সকালে উঠে ভয়, আজও যদি না হয় তাহলে কী হবে ইত্যাদি। পেট পরিষ্কার রাখার নিয়ম কানুন মেনে চললে, দু'একদিন কোনও কারণে না হলে বেশি ভাবনা চিন্তা না করাই ভাল। এই অভ্যেস যদি এক্ষুনি ভাগ করতে পারেন দেখবেন সমস্যার সঠিক সমাধান হয়ে গেছে। ওষুধপত্র কালে ভদ্রে দু চারবার খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাকে অভ্যেসে পরিণত করলে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করবেন। সেক্ষেত্রে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান আর হবে না। ওষুধ ছাড়া আর পায়খানা হতে চাইবে না। 

❍ প্রশ্ন: কড়া টয়লেট ট্রেনিং থেকে নাকি অনেক সময় কোষ্ঠবদ্ধতার সৃষ্টি হয়?

☛ উত্তর: সকালে টয়লেটে যেতেই হবে, বেগ না এলেও বসে থাকতে হবে-এই ধরনের অভ্যেস না করানােই ভাল। ছোটবেলা থেকে এই ধরনের শিক্ষা পেতে পেতে এক ধরনের অবসেশন জন্মে যাওয়ার খুব সম্ভাবনা। যা থেকে পরবর্তীকালে এসব অকারণ সমস্যার উম্ভব। যেটা উচিত বেগ পেলে টয়লেটে যাবে এবং পেট পরিষ্কার রাখার নিয়ম কানুন মেনে চলবে। এক দু’দিন না হলে বা দু এক বারের বেশি হলে বেশি আতঙ্কিত হবেনা। বেশি সমস্যা স্কুল ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

❍ প্রশ্ন: কখনও পেট খাৱাপ কখনও কোষ্ঠবদ্ধতা এরকম পর্যায়ক্রমে চলতে থাকলে কী করতে হবে? 

☛ উত্তর: এরকম চলতে থাকলে প্রথমে দেখুন আপনার খাদ্যাভ্যাসে কোনও ত্রুটি আছে কিনা। খাদ্য খাওয়ার অনিয়ম এবং খাবারে রাফেজের অভাব থাকলে এরকম হতে পারে। নিয়ম মেনে হালকা খাবার খান এবং দিনে দু'বার দু'চামচ করে ইসবগুলের ভুষি খান দু এক সপ্তাহ। এতে সমস্যা না মিটলে ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগ করুন। 

❍ প্রশ্ন: ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম হলে নাকি এরকম হয়? 

☛ উত্তর: হতে পারে। তবে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমে আক্রান্ত বলে কাউকে চিহ্নিত করার আগে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়ােজন হয়। আসলে স্ট্রেস, টেনশন, অনিদ্রা, পেটের রােগ আমাদের অনেকেরই নিত্যসঙ্গী। ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের মূলেও এদের কিছু ভূমিকা আছে। তাই অনেক সময় ভুল হতে পারে। মল পরীক্ষা, আপার জি আই এন্ডােস্কোপি, কোলোনােস্কোপি ইত্যাদি করে অন্য কোনও রােগের হদিস না পেলে তবেই বলা যাবে রােগটি আই বি এস। 

❍ প্রশ্ন: অনেক সময় সামান্য খাওয়া দাওয়ার অনিয়মে ওপর পেটে চাপ ধরা ব্যথা হয়। কী করতে হবে? 

☛ উত্তর: খাওয়া দাওয়ার গণ্ডগােল হলে গ্যাসট্রাইটিস হতে পারে। এসময় কয়েকদিন একটু হালকা খাবার খেতে হবে। সাধারণত এতেই অবস্থা আয়ত্তে আসে না এলে বা মাঝে মধ্যেই উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন। 

❍ প্রশ্ন: গ্যাসট্রাইটিস আর কোলাইটিস কি একই রােগ? 

☛ উত্তর: না, গ্যাসট্রাইটিসে আক্রান্ত হয় পাকস্থলী। তেল মশলাদার খাবার, ভাজাভুজি, অ্যালকোহল, ব্যথার ওষুধ ইত্যাদি লাগাতার খেয়ে চললে গ্যাসট্রাইটিসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কোলাইটিস অথাৎ কোলনে প্রদাহ নানা কারণে হতে পারে। আমাদের দেশে আমাশার জন্য অ্যামিবিক কোলাইটিস বেশি হয়। 

❍ প্রশ্ন: আমাশার ঘরােয়া কিছু সমাধান বলুন। 

☛ উত্তর: প্রথম এবং প্রধান-জল ফুটিয়ে খাওয়া। শাক সবজি, স্যালাড খেতে চাইলে পরিষ্কার জলে বারবার ধুয়ে তারপর খেতে হবে। এবং অল্প পরিমাণে খেতে হবে। উপসর্গ অথাৎ পেটে মােচড় দিয়ে ব্যথা, বারবার পায়খানার বেগ এবং পায়খানার সঙ্গে আম পড়তে থাকলে একটা দুটো এনটেরােকুইনল খেয়ে চাপা দেওয়ার অভ্যেস ত্যাগ করতে হবে। এতে অসুখ বারবার ফিরে আসে। এবং পরবর্তী কালে আর কোনও ওষুধ কাজ করে না। দীর্ঘস্থায়ী আমাশার পরিণতিতে লিভারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কাজেই ওষুধ যদি একবার খেতে শুরু করেন অন্তত ৫ দিন খেতে হবে। 

❍ প্রশ্ন: খালিপেটে থানকুনি পাতার বস খেলে নাকি আমাশা ভাল হয়ে যায়? 

☛ উত্তর: যে পরিবেশে আমরা বাস করি তাতে আমাশা পুরােপুরি ভাল হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। থানকুনি পাতার রস খেলে কোনও অসুবিধে নেই। তবে ভাল করে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন ভাবে তৈরি করলে সমস্যা বাড়বে। 

❍ প্রশ্ন: পেপে কাঁচকলা দিয়ে সিঙি মাগুরের ঝােল? 

☛ উত্তর: খেতে পাবেন সহজ পাচ্য বলে। তবে নিয়ম করে খেলে আমাশা হবে না এমন কথা বলা যাবে না। 

❍ প্রশ্ন: আর অম্বল? অম্বলের হাত থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে? 

☛ উত্তর: মাঝে মাঝে গলা বুক জ্বালা, পেট জ্বালা বা টক ঢেকুর উঠলে বুঝতে হবে আপনি অম্বলে ভুগছে। ওষুধ খাওয়ার আগে নিজের খাদ্য তালিকার দিকে তাকান। এক একজন মানুষের এক একটি জিনিসে অম্বল হয়। কেউ আটার রুটি খেতে পারেন না। কেউ পাউরুটি। কিছু বিশেষ ফল খেলে অম্বল হয় অনেকের। দই খেতে পারেন না কেউ কেউ। তেল মশলাদার খাবার, ভাজাভুজিতে অধিকাংশ মানুষের অম্বল হয়। অনিদ্রা, মানসিক চাপ, টানাপােড়েন তাে ডেকে আনে অম্বলকে। অতএব খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে অম্বলকে আয়ত্তে রাখতে হবে। নেহাত বাড়াবাড়ি হলে মাঝেমধ্যে অ্যান্টাসিড জাতীয় কিছু খেতে পারেন। তবে অভােস করে ফেলবেন না। আর নিয়মিত পেট পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করবেন। 

❍ প্রশ্ন: খাওয়া দাওয়ার নিয়ম মেনে এবং পেট পরিষ্কার রেখেও তাে অনেক সময় অম্বলের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না? 

☛ উত্তর: খাওয়া দাওয়ার নিয়ম কানুন মেনে চললে, ধূমপান, মদ্যপান যথাসম্ভব এড়িয়ে গেলে এবং পেট পরিষ্কার থাকলে অম্বলের সমস্যা আয়ত্তে থাকে। এসবে কোনও ফল না হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যােগাযােগ করুন। দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসার দরকার হতে পারে। 

❍ প্রশ্ন: সাবেক অ্যান্টাসিড ছাড়াও অম্বল কমানাের জন্য তাে আজকাল নানারকম ওষুধ পাওয়া যায়। ফ্যামােটিডিন, র্যানিটিডিন বা ওমিপ্রাজোল। খেলে উপকারও হয় বেশি। 

☛ উত্তর: অম্বল সারাতে বিভিন্ন ভাবে এই সমস্ত ওষুধগুলি কাজে আসে। অ্যান্টাসিডের কাজ পাকস্থলিতে অ্যাসিড তৈরি হওয়ার পর তাকে প্রশমিত করা। আমাদের পাকস্থলির কোষে দু ’ ধরনের হাইড্রোজেন রিসেপটর থাকে। এরা অ্যাসিড তৈরি করে। ফ্যামােটিডিন, র্যানিটিডিন এই সমস্ত হাইড্রোজেন রিসেপটরকে আটকে দিয়ে অ্যাসিড তৈরি কমিয়ে দেয়। ওমিপ্রাজোল কাজ করে কোষের গভীরে। তারও কাজ অ্যাসিড তৈরিতে বাধা দেওয়া। সুক্রালফেট জাতীয় ওষুধ পাকস্থলিতে প্রলেপ তৈরি করে অ্যাসিডের ক্ষতিকর প্রভাব কমায়। কার ক্ষেত্রে কোন ওষুধ প্রয়ােজন সেটা ঠিক করবেন চিকিৎসক। সেই অনুযায়ী কিছুদিন ওষুধ খাওয়া দরকার। কিন্তু হয় ঠিক এর উল্টোটা। যাঁরা বেনিয়মে অভ্যস্থ তাঁরা যখন দেখেন অনিয়ম সত্ত্বেও ওমিপ্রাজোল বা র্যানিটিডিনের প্রভাবে অম্বলের সমস্যা কমছে, ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এটা কখনও ঠিক নয়। 

❍ প্রশ্ন: এমন কিছু পথ নেই যা মেনে চললে পেট ঠিক থাকবে? 

☛ উত্তর: নিশ্চয়ই আছে। তবে এ তাে অ্যাপেনডিক্স, হার্নিয়ার মতাে ব্যাপার নয় যে অপারেশন হল আর রােগ ঠিক হয়ে গেল। আগে যে রকম বলেছি খাওয়া, ঘুমের নিয়ম ঠিক রাখা, পেট পরিষ্কার রাখা এবং অশান্তি উদ্বেগকে কিছুটা হলেও এড়িয়ে চলতে পারলে সুস্থ থাকা সম্ভব। 
Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url